এন. আর. সি. , এন. পি. আর. , সি. এ. এ. কী জনবিন্যাস রক্ষা করবে?
বিনায়কবাবুর বহুদিনের শখ, একবারের জন্য অত্যন্ত পিতৃভিটের মাটি স্পর্শ করবেন, সে আশা কী পূর্ণ করবে মৈত্রী এক্সপ্রেস?
জানতে হলে পড়ুন “মৈত্রী এক্সপ্রেস”...
- গল্পের নাম : মৈত্রী এক্সপ্রেস
- লেখক : দেবদাস কুণ্ডু
- বিষয় : গল্প
- ভাষা : বাংলা
- সাইজ : ৩০ কে.বি.
- পৃষ্ঠা সংখ্যা : ০৫
অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরে।
মেইল আইডি : debdas.anita@gmail.com
প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর
- সর্বশেষ আপডেট : ৫ ই অক্টোবর, ২০২০
- শৌভিক দে
- লেখক পরিচিতি :
- লেখক বক্তব্য :
অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর যখন প্রথমবারের জন্য দেখলাম বেশ অবাক হয়েছিলাম। সাথে সাথে চটপট একটা লেখাও পড়ে ফেললাম, বেশ ভালো লাগলো। ব্লগের অলংকরন খুব সুন্দর, এছাড়া বিষয় ভাবনাও প্রশংসনীয়। সত্যিই সাধুবাদ প্রাপ্য। আমার লেখাটা প্রকাশিত হওয়ায় খুব আনন্দিত হলাম।।
- প্রয়োজনীয় ট্যাগ : অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর, গল্প, দেবদাস কুণ্ডু, অনলাইন স্টোরি, বাংলা সাহিত্য, মৈত্রী এক্সপ্রেস, ই-স্টোরি।
‘‘আমি তো তোদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।’’
‘‘আমরা তো মামাশ্বশুরের বাড়ি। একটা ফোন করে তো আসবে!”
‘‘ভুল হয়ে গেছে। দাদুভাইকে দেখি না কতদিন। মোবাইলে দেখে সুখ হয় না। জানিস তুই, তোর বাবা সব কিছু স্পর্শকরে সুখ পায়।”
‘‘জানি তো। তুমি চিন্তা করো না। আমি দু’দিন পর যাচ্ছি।”
২
গুটিকয় যাত্রী নিয়ে বিরাট লম্বা স্টেশন ঘুমোচ্ছে দুপুরের ফিকে রোদ গায়ে
নিয়ে। আমি সেই ঘুমন্ত প্লাটফর্মের বুকে পা ফেলে এদিক ওদিক হাঁটি, যাকে বলে, পায়চারি।
হঠাৎ চমকে উঠি। পাশের লাইনে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচের জানালা, সবুজ
রং-এর সুদৃশ্য একটা ট্রেন। তার গায়ে লেখা “বাংলাদেশ রেলওয়ে”; মৈত্রী এক্সপ্রেস, বাতানুকুল কামরা। আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ যেন টনটন করে উঠলো। কাঁচের জানালা খুলে
বাইরে তখন অনেক মুখ।
আমি প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে। এগিয়ে গিয়ে ট্রেনটার গায়ে হাত রাখলাম। স্পর্শ করলাম। একটা সুখ বুকের ভিতরে। হাতে লাগলো ট্রেনের সামান্য ধুলো মাটি।
“আহ হাঃ , এতো বাংলাদেশের মাটি।”
এদিকে ঢুকে পড়ে আমার রিটার্ন ট্রেন।
ছেড়েও দিলাম, উঠিনি।
মৈত্রী এক্সপ্রেসের শেষ কামরায় মুখ রাখি, ‘‘আপনারা কোন জেলা থেকে
আসছেন?’’
ভিতরের যাত্রী বলে, ‘‘কুমিল্লা।’’
পরের কামরায়, ‘‘আপনারা কোন জেলা থেকে আসছেন?’’
‘‘বরিশাল।’’
পরের কামরা, ‘‘আপনারা কোন জেলা?’’
‘‘নোয়াখালি।’’
‘‘আপনারা?’’
‘‘নারায়ণগঞ্জ।’’
‘‘আপনারা?’’
‘‘চিটাগাঙ।’’
শেষ কামরা : ‘‘আপনারা?’’
‘‘ফরিদপুর।’’
‘‘দেভোগ, পালং মাদারিপুর সাবডিভিশন।’’
আমার বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে ওঠে, কেমন একটা আনন্দ মাথা জুড়ে জেগে
ওঠে। আমি বলি, ‘‘আমার বাবার দেশ তো ছিল ফরিদপুর।’’ আমি জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেই।
গালে দাড়ি, মাথায় টুপি, ফর্সা, গায়ে সাদা পাঞ্জাবী ওপরে জহর কোট। লোকটা
চমকে ওঠে, ‘‘কে আপনি?’’
‘‘আপনার দ্যাশের লোক।’’
‘‘চিনতে তো পারতাছি না?’’
‘‘কেমনে চিনবেন? জন্ম তো আমার ভারতে। কিন্তু বাবা ফরিদপুর। তার রক্ত বইছে
শরীরে। কিন্তু মাটির গন্ধ নাই?’’
‘‘কে কইছে নাই? আপনার কথায় তো ফরিদপুর জাইগা উঠছে।”
আমার বাড়ানো হাত মুঠিতে
নিল লোকটি। শরীরের ভিতর কেমন একটা শিহরণ। দুটি রাষ্ট্র। দুটি হাত। কিন্তু
কণ্ঠস্বর এক, ভাষা এক।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আমি হাঁটছি। বাংলাদেশের হাতের মুঠোয় ভারতের হাত। ট্রেন
ছুটছে। আমি ছুটলাম। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল।
আমি বিনায়ক মজুমদার, স্বর্গীয় হরিদাস মজুমদারের ছেলে। ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে
দেখছি, মৈত্রী এক্সপ্রেস ক্রমশ আমার চোখের পরিধির বাইরে চলে যাচ্ছে।
নাকটা চুলকাচ্ছে বড্ড। ডান হাতটা নাকের কাছে আনতে অদ্ভুত একটা গন্ধ। ভীষণ, ভীষণ একটা আনন্দ হচ্ছে।
এটা কি ফরিদপুরের মাটির গন্ধ? পরক্ষণেই মনে হল, কি করে বুঝবো? আমি তো কোনদিন ফরিদপুর যাইনি।
আমি ফেরার ট্রেনে নামি উল্টোডাঙা। আমার ফ্ল্যাটে কিছু ফুল গাছ আছে। আমি বাঁ হাতে মাটি নিলাম। ডান হাতে ফরিদপুর। দু’জায়গায় গন্ধ একই মনে হলো নাকের কাছে নিতে। কি আশ্চর্য দু’জায়গার মাটির গন্ধ যখন এক, তখন সেই মাটি ভাগ করল কারা? যার জন্য আমার বাবা মাকে প্রাণের ভয়ে চলে আসতে হয়েছে এই বঙ্গে। লড়াই করে যুদ্ধ করে এখানে প্রতিমুহূর্তে টিকে থাকতে হয়েছে। রিফিউজির তকমা নিয়ে।
এসব ভেবে এত বছর পর ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি আমি। তখন বুকের ভিতর কে যেন বলল, ‘‘তুমি ভুল ভাবছো! যারা তোমার বাবা-মাকে বাস্তুভিটে দেশছাড়া করেছিল, তারা নেই। ২০ বছরে তাদের প্রজন্ম পালটে গেছে।”
বারান্দার এক চিলতে জমিতে দাঁড়িয়ে ভাবি, সত্যিই কি পালটে গেছে? মনে পড়ল কিছুদিন আগে এক বন্ধু বলছিল, ‘‘কি বলবো তোকে বিনায়ক, আমি তো রাতের বাসে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরি। ওখানে আমার ব্যবসা আছে। প্রায়ই দেখি মাঝরাতে স্বামী, স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসে উঠে পড়েছে গোটা পরিবার। এরা কলকাতায় নেমে শহরে অরণ্যে মিশে যাচ্ছে প্রতিদিন।’’
আমার মনে হল, তাই কি সীমান্ত অঞ্চলের জনবিন্যাস নষ্ট হচ্ছে? তাই কি সি.এ.এ, এন.আর.সি., এন.পি.আর?
আমি বিনায়ক মজুমদার, সন্ধ্যার অন্ধকারে বারান্দার চেয়ারে বসে বুঝতে পারি, যে
লাইন দিয়ে মৈত্রী এক্সপ্রেস চলছে, সেই একি লাইন দিয়ে অনুপ্রবেশ এক্সপ্রেসও চলছে।
তবে কি দু’দেশের রাষ্ট্রনায়করা মিথ্যের
বেসাতি করছে না!
৩
একটু আগে স্ত্রী হঠাৎ বলল, ‘‘কি গো ঘরের কোন আলো যে জ্বলছে না!”
‘‘দেবু তো আমায় কথা দিয়েছিল। লাইন ঠিক করে দেবে। এলো না।”
আসলে সকলে মিথ্যে বলে। কেউ কথা রাখে না। রাষ্ট্রনায়কদের মতো! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এইসব অনুভবে। কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠলো সুরেলা কণ্ঠস্বরে।
মনে হলো, মানুষ নয়, কেন আমি ঐরকম একটা পাখি হয়ে জন্মালাম না!