যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা : দেবদাস কুণ্ডু

কাশ্মীরে যুদ্ধের আবহাওয়া চলছে এখনও! 


সুদর্শন আজ সাইকেল নিয়ে ডঃ দাশের চেম্বারে না গিয়ে সোজা চলে এলো হাসপাতালে। 

হাসপাতালে ঢুকেই মূর্তিটার দিকে চোখ চলে গেল তার...

তারপর...

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা : দেবদাস কুণ্ডু



Img. Loading...
 অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরে সর্বাধিক বাৎসরিক ভিউপ্রাপ্ত লেখাটির জন্য থাকবে আকর্ষণীয় উপহার, এছাড়া সর্বাধিক কমেন্টপ্রাপ্ত লেখাটির জন্য রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায় সরাসরি জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ। আপনিও লেখা পাঠাতে পারেন উপরের মেনুবারে দেওয়া অপশনে  গিয়ে। বিশদে জানতে যোগাযোগ করুন এই নম্বরে: 8013850709

  • গল্পের নাম : যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা 
  • লেখক :  দেবদাস কুণ্ডু
  • বিষয় : বড়গল্প
  • ভাষা :  বাংলা
  • সাইজ : ১৫০ কে.বি.
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা : ০৮

 সংলগ্ন তথ্য : 

ব্লগে লিখুন
এখন আপনিও খুব সহজে নিজের লেখা প্রকাশ করতে পারবেন
অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরে
লেখককে লিখুন
গল্পটি পড়ে লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
মেইল আইডি : debdas.anita@gmail.com
©️ কপিরাইট
লেখক এবং প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া গল্পটির কোনোরূপ ব্যবহার বরদাস্ত করা হবে না,
প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


  • অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর
  • সর্বশেষ আপডেট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০
  • শৌভিক দে


“যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা” গল্পটি এখন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আপনি পড়তে পারবেন অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরে । গল্পটি আমাদের দিয়েছেন লেখক শ্রী দেবদাস কুণ্ডু মহাশয়। আপনি মূল গল্পটির মোট দুটি সংস্করণ পড়তে পারবেন : এম্বেড সংস্করণ এবং ব্লগ সংস্করণ। গল্পটি নিজেরা পড়ুন এবং অন্যদেরকেও পড়ার সুযোগ করে দিন শেয়ারের মাধ্যমে।


  • লেখক পরিচিতি :  
✓ নাম : দেবদাস কুণ্ডু
✓ বয়স : ৬০
✓ ঠিকানা : ৬ডি, গোরাপদ সরকার লেন , ব্লক-বি, ফ্ল্যাট-৪,  কলকাতা-৭০০ ০৬৭ 
✓ মেইল আইডি : debdas.anita@gmail.com 
✓ সম্পর্ক : লেখকের সাথে অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরের পথ চলা শুরু হলো “যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা” গল্পটির হাত ধরে। আশা করি এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং দর্শকদের কাছে সুমধুর সম্পর্কের রূপ নেবে।

  • লেখক বক্তব্য :
    অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর যখন প্রথমবারের জন্য দেখলাম বেশ অবাক হয়েছিলাম। সাথে সাথে চটপট একটা লেখাও পড়ে ফেললাম, বেশ ভালো লাগলো। ব্লগের অলংকরন খুব সুন্দর, এছাড়া বিষয় ভাবনাও প্রশংসনীয়। সত্যিই সাধুবাদ প্রাপ্য। আমার লেখাটা প্রকাশিত হওয়ায় খুব আনন্দিত হলাম।।


  • প্রয়োজনীয় ট্যাগ :  অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তর, বড়গল্প, দেবদাস কুণ্ডু, অনলাইন স্টোরি,  বাংলা সাহিত্য, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, ই-স্টোরি।


এম্বেড সংস্করণ :

গল্পটির মূল এম্বেডেড কপিটি পড়ুন নিচের অংশে : 





ব্লগ সংস্করণ :


“কাশ্মীরে এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে।” 
কে বলল কথাটা?
মনে পড়ছে না। 

অরবিন্দ সেতু বড় খাড়া। সেটা পার করে হাঁপাচ্ছে সুদর্শন। এবার সোজা অরবিন্দ সরণি না ধরে ডানদিকে এপিসি রোড ধরল। উল্টোডাঙা মোড় পার করে ঢুকে পড়ল মোহনবাগান লেনে; শ্যামবাজার ট্রাম রাস্তায় এসে পড়ল। ট্রাম রাস্তা পার করে সোজা গেলে ড্রাফ স্কুল। স্কুলকে ডানদিকে রেখে বাঁদিকে শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরল। এই সব রাস্তাগুলিতে গাড়ি চলাচল কম। সাইকেল চালাতে ভাল লাগে তার। পাড়াগুলি প্রায় নিস্তব্ধ। দু’পাশে বড় বড় বনেদি বাড়ি। তার মাঝে নতুন পোশাকে ফ্ল্যাটবাড়ি। সেগুলো ছ’তলা সাত তলা। তার পাশে বনেদি বাড়িগুলিকে বেঁটে বামুন বলে মনে হয়। দু’তলা তিন তলাতেই শেষ। তবে বাড়িগুলি শান্ত। একটা বাড়ির কাছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মূর্তি। এটা তার বাসভবন। এক মুহূর্ত থামল। বাড়িটাকে দেখল। এর আগেও দেখেছে। প্যাডেল করে কিছুটা এগিয়ে গেল। ডান হাতের বাড়িটা শ্যামপুকুর বাটি। এই বাড়িতে রামকৃষ্ণ কিছু দিন ছিলেন। আবার এক মুহূর্ত দাঁড়াল সে। বাড়িটা দেখল। আগেও দেখেছে। আসলে এই বাড়িগুলির পাশ দিয়ে সে যখন যায়, প্রাচীন শতাব্দীর গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। একটা শিহরণ হয়। সাইকেলের চাকা নিজে থেকেই থেমে যায়। সে নয়, এই সাইকেলটি যেন বাড়িগুলিকে শ্রদ্ধা জানাতে থেমে পড়ে। এখন থামলে চলবে না। এগিয়ে গেল, লাহা পার্ক। আগে লাহাদের বাড়ি ছিল। পার্ক ডানদিকে রেখে বাঁদিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। তিন মিনিটে সাইকেল এসে দাঁড়াল অরবিন্দ সরণির পেটে। রাস্তার ওপর চারতলা একটা বাড়ি। ভোলানাথ আয়ুর্বেদ হাসপাতাল ও কলেজ। নিচে গাড়ি বারান্দা। ঘড়ি দেখল। একটু বেশি সময় লেগেছে আসতে। সোজা অরবিন্দ সরণি ধরলে তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারত। অরবিন্দ সরণি ঋষির মতো তা নয়। সর্বদা ছুটছে গাড়ি। অটোগুলো ছুটছে বেপেরায়া। বাইকগুলি হাওয়ায় উড়ে যায়। ফুটপাত না থাকায় মানুষগুলো মৃত্যুকে হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটে। আজ বুধবার, হরিসাহার হাট, সারারাত হাট চলে । সকালেও জমজমাট থাকে। একটু নিরিবিলি রাস্তা সুদর্শনের পছন্দ, বিশেষ করে আভিজাত্য পাড়ায় নিঝুম বাড়িগুলি দেখতে দেখতে সাইকেল চালাতে বেশ লাগে। কয়েক দিন আগের দেখা পুরানো বাড়ি হঠাৎ ভেনিস। তার গর্ভে জন্ম নিয়েছে আটতলা বাড়ি। কষ্ট হয়, কিছু পুরনো বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে হাড় কঙ্কাল নিয়ে। নির্ভীক অশ্বত্থ গাছ একা সেই বাড়ির বাসিন্দা। 


‘‘কি সুদর্শনদা আপনি?’’ 
হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডের কথায় সুদর্শন তাকায়। গার্ড লোকটি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। 

‘‘এই ডাঃ দাসকে দেখাব।’ ’

গার্ড লোকটি রাস্তায় নেমে সামনের দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। সুদর্শন সাইকেলটা গাড়ি বারান্দায় নিচে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। সামনের চাকায় চেন গলিয়ে রেন পাইপের সঙ্গে বাঁধল। পিছনের চাকা লক করল। কিছুদিন আগে বাজার থেকে সাইকেল চুরি গেছে, পিছনের চাকা লক থাকা সত্ত্বেও। চোররা এখন কোমরের সঙ্গে হুক রাখে। সেই হুকে সাইকেলের ক্যারিয়ার আটকে দেয়, তারপর দিব্যি সাইকেল নিয়ে চলে যায়। পিছনের চাকা মাটি থেকে দু’সুতো উঁচুতে থাকে। কেউ বুঝতেই পারে না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চোরদের এই অভিনব কৌশল শুনে সে মুগ্ধ হয়েছিল। চার হাজার টাকা দিয়ে নতুন সাইকেল কিনে সেই মুগ্ধতা আর বজায় রাখতে চায়নি। সেই থেকে সামনের চাকা পরাধীন। চেন-তালায় বন্দি।

‘‘কি ব্যাপার ডাঃ দাসকে দেখাতে এসেছেন?’’ 
সিকিউরিটি গার্ড আবার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘‘এখন ডাঃ দাশের আন্ডারে চিকিৎসা করছি।’’ 

দু’জনেই আউট ডোরে ঢুকে পড়ে। সিকিউরিটি গার্ড তার চেয়ারে গিয়ে বসে। আউট ডোরে থিকথিকে ভিড়। এত ভিড়ের জন্যই সুদর্শন প্রাইভেট ডাক্তার দেখায়। এখন বাধ্য হয়ে হাসপাতাল আসতে হল। ‘ও.পি.ডি. ১’-এর দরজা ঠেলে ডাঃ দাশকে মুখটা দেখাল। ইঙ্গিতে ডাঃ দাশ তাকে অপেক্ষা করতে বলল। 

সুদর্শন একটু সরে এসে মূর্তিটার দিকে তাকাল। সাদা পাথরের একটা আবক্ষ মূর্তি। নিচে নাম, জন্মসন, মৃত্যুসন সবই আছে। ওনার নাম লোভানাথ মিত্র। এই বাড়িটা একশো বছর আগে তিনিই দান করে গেছেন। ভাবলে অবাক লাগে এই রকম জমজমাট অরবিন্দ সরণির ওপর চারতলা একটা বাড়ি লোকটা দান করে গেছে। কত বড় হৃদয়!

‘‘ও সুদর্শনদা এদিকে আসুন।’’
সিকিউরিটি গার্ড তাকে ডাকছে, ‘‘আপনি এই চেয়ারে বসুন।’’ 

গার্ড লোকটি উঠে দাঁড়ায়, বলে, ‘‘দিদি কেমন আছেন?’ ’

দিদি মানে তার স্ত্রী ঊর্মিমালার কথা বলছে। উর্মিমালা এই হাসপাতালের স্টাফ নার্স।

‘‘দিদি হাত ভেঙে বাড়িতে বসে আছেন।’ ’

‘‘কি করে হল?’ ’

‘‘এসকারশনে গিয়ে বরফে পড়ে গেছে।’’

“আপনি যাননি?”

‘‘না। সুপার বলেছিল। আমি যাইনি।’ ’

‘‘কেন?’’

‘‘দিনে আট দশবার পটি হয়। লুজ মোশন হয়। গ্যাসটিকের তীব্র ব্যথা। এসব নিয়ে যাওয়া যায়?’’

‘‘তা ঠিক। এই তো দেখুন না আমার তো জন্ডিস। তাই নিয়ে ডিউটি করছি।’ ’

‘‘কেন? আপনি তো বেড রেস্টে থাকবেন।’ ’

‘‘আমরা তো এজেন্সির লোক। নো ওয়ার্ক, নো পে। ঘরে বসে থাকলে চলবে?’ ’

এই লোকটি তার বেশ পরিচিত। তবু কোনদিন নাম জিগ্যেস করেনি সুদর্শন। আসলে সে দেখেছে। আলাদা আলাদা লোক হলেও তার সঙ্গে যাদের আলাপ হয় তারা যেন সব এক ছাঁচে ঢালা। অনিশ্চয়তা, বিষন্নতা, দরিদ্রতা, অসুস্থতা টেনশন সবারই আছে। তাই সে আলাদা করে কারও নাম জানতে চায় না। কিন্তু কথার ফাঁকে নিজের নামটা জানিয়ে দেয়, সুদর্শন পাল। মোটেও সে সুদর্শন নয়। বাবা, মা এই নামটা দিয়ে সারা জীবন তার সঙ্গে একটা ঠাট্টা জুড়ে দিয়েছে। আরও হাস্যকর তার নাম সংক্ষেপে সুধা। একটা মহিলার নাম সে পুরুষ হয়ে বহন করে চলেছে এত বছর ধরে। সে যাক। নাম না জানলে লোকে এই যে, ওহে, ও দাদা এইসব বিশেষনে ডাকে, সুদর্শন সাড়া দেয় না। এই যেমন সেদিন পার্কে একটা লোক তার সামনে এসে দাঁড়ালো!
“আপনাকে ডাকছি শুনতে পারছেন না?’ ’

“আপনি কি আমার নাম ধরে ডেকেছেন? কেন শুনব?”

“ও হো ভুলে গেছি। এবার মনে পড়েছে। আপনার নাম সুধাদা।”

“হ্যাঁ এবার বলুন কি ব্যাপার?”

“শুনলাম আপনি এল.আই.সি করেন। আমার একটা বন্ড হারিয়ে গেছে। এজেন্টও মারা গেছে। আপনি যদি একটু সার্ভিস দেন।”

“একটু কেন। পুরো সার্ভিস দেব। আগে নতুন পলিসি একটা করতে হবে।”

“কি হল আপনি বসছেন না কেন?’’
সিকিউরিটি গার্ডটি বলে ওঠায়, সুদর্শন সচেতন হয়। ফাঁকা চেয়ারে বসে। আজকাল বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। পটিপটি ভাব থাকে। চেয়ারে বসলে বেগটা ভিতরে ঢুকে যায়।
চেয়ারে বসে সুদর্শন বলে, ‘‘স্যারের আউটডোরে বেশ ভিড় তো!’ ’

‘‘হবে না! মরা মানুষ স্যার জ্যান্ত করে দিচ্ছে। সব প্যাথি করে শেষে তো আয়ুর্বেদে আসে। আয়ু ফুরিয়ে আসে আয়ুর্বেদে। স্যার আবার ওষুধে তাদের আয়ু বাড়িয়ে দেয়। এই যে দেখছেন হাসপাতালটা গমগম করছে। কম্পিউটার বসেছে, ল্যাব হয়েছে, অপারেশন থিয়েটার হয়েছে। লিফট হয়েছে। কেবিন হয়েছে। এসব তো স্যারের চেষ্টায় হয়েছে। ”

সুদর্শনের চোখে ভেসে উঠল পনেরো বছর আগের হাসপাতালের চেহারাটা। উর্মিমালা টান্সফার হয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে এই হাসপাতালে, তাও মেডিকেল গ্রাউন্ডে। প্রথম দিন সঙ্গে সেও এসেছিল। মলিন, খুব পুরনো পলেস্তরা খসা একটা জীর্ণ বাড়ি। নোংরা, বিড়ালের আনাগোনা। অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মেল, ফিমেল ওয়ার্ডে গুটিকয় পেশেন্ট। তারা নাকি বছর বছর ধরে এখানেই আছে। সুস্থ হলেও বাড়ি যায় না। বাড়ির লোক নিতে আসে না। অথচ এটা মেন্টাল হাসপাতাল নয়। ফার্মাসিস্ট ক্লাস ঘরটা ধুলো মলিন। কিছু পেশেন্ট খুবই বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, সেদিন ঘুরে ঘুরে দেখে তার মনে হয়েছিল, এটা হাসপাতাল নয়, বৃদ্ধাশ্রম।


সুদর্শন পাল, মাইকে নিজের নামটা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঢুকে পড়ে ও.পি.ডি. ১-এ। ডাঃ দাশ, তাকে দেখিয়ে জুনিয়র ডাক্তারকে বলেন, ‘‘এনি উর্মি সিস্টারের হাজব্যান্ড।’ ’

জুনিয়ার ডাক্তারটি নমস্কার জানায়। তারপর একগাদা টিকিটের ভিতর তার টিকিটটি খুঁজতে থাকে, পায় না। 

ডাঃ দাশ বলেন, ‘‘সিস্টার ভুলে গেছেন। আপনি টিকিট করে আসুন।’ ’

সুদর্শনের মাথায় হালকা উত্তাপ ছড়াল। উর্মি মেয়ের বাড়ি গেছে গতকাল। আজ সকালে ফোনে কথা হল উর্মি ফোনে টিকিট করে রাখবে। কাউন্টারের ছেলেটি ডাঃ দাশের টেবিলে টিকিট পৌঁছে দেবে। কিন্তু কোথায় কি? উর্মিকে একটা ফোন করল, রিংটোন বাজছে,

“ও মাঝিরে আপনা কিনারা নদীয়াকে ধারামে...”

বেজে গেল। 
ধরল না। 
সুদর্শন টিকিট কাউন্টারে গিয়ে নাম ধাম বয়স সব বলল। ছেলেটি কম্পিউটারে বোতাম টিপতে গিয়ে একবার তার মুখের দিকে তাকাল, ‘‘আপনি তো জামাইবাবু। দিদি ফোনেই তো বলতে পারত।’’

সুদর্শন বললেন, ‘‘সে রকমই কথা ছিল, রাখল কই।’’

‘‘উর্মিদিদির খুব ভুলো মন।’’

সুদর্শন মনে মনে ভাবে, ভুলো মন! কত তারিখে কত টাকা সংসারে দিল সব হিসেব রাখে। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা অফিসে আত্মভোলা থাকে। বাড়িতে স্বমূর্তি ধরে। দু’রূপের ব্যালেন্স করে চলতে পারে বেশ।
টিকিট নিয়ে ডাঃ দাশের ঘরে ঢুকতেই ডাঃ দাশ বেরিয়ে গেলেন। এখন তিনি দোতলায় ঘরে বসবেন। সুপারের চেয়ারে। আবার অন্যদিন ফার্মাসিট ক্লাসের শিক্ষক। স্বাস্থ্যভবন যেতে হয় ঘনঘন। আউটডোরের কাজের মধ্যে কত অফিসিয়াল কাজ পড়ে। তখন তিনি সুপার। পেশেন্টকে বসে থাকতে হয়।
তাড়াতাড়ি স্যারকে দেখিয়ে ওষুধ কিনে একটার মধ্যে বাড়ি ফিরে যাবে। দেরি হলে গ্যাসটিকের ব্যাথা তীব্র হবে। তখন খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। একটা আতঙ্ক হয়। এই, এই বুঝি ব্যথাটা আরও তীব্র হল। সময় যাবে। ব্যথার তীব্রতা বল্লমের খোঁচার মতো যন্ত্রণাদায়ক হবে। 
এক গ্যাসট্রোএন্টোলজিস্টকে ব্যাথাটা বোঝাতে গিয়ে সুদর্শন বলেছিলেন, ‘‘তখন আমার মনে হয় পাকজঙ্গী আমাকে আক্রমণ করেছে। আমি নিরীহ ভারতবাসী। আত্মরক্ষায় ছুটছি।’’

 ডাঃ চক্রবর্তী শুনে বলেছিলেন, “কেউ আপনার মতো এমন করে বলেননি তো! আচ্ছা আপনি কি কবিতা লেখেন, কিংবা গল্প? ”

“না।”

“তাহলে এমন মনে হল কেন আপনার?”

‘‘কাগজে তো কাশ্মীরের ঘটনা প্রায় পড়ি। রাতে খেতে বসে খবর শুনি।’ ’

‘‘বুঝেছি।’ ’

কি বুঝে ছিলেন চক্রবর্তী, কে জানে। তার ওষুধে কাজ হয়নি। এ্যালাপ্যাথটা ছেড়ে কিছুদিন হোমিওপ্যাথি, সেখানেও ফল শূন্য। এখন শেষ ভরসা আয়ুর্বেদ। ডাঃ দাশই একদিন উর্মিকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠাল। সব রিপোর্ট দেখল, বলল, ‘‘ফ্যাটিলিভার, কমবেশি সবার আছে, এন্টাল গ্যাসটাইটিস! দীর্ঘ সময় না খেয়ে থেকে হয়েছে, সেরে যাবে। ছ’ সাতবার পটি হয়, ওটা টেনশন এবং ফ্যাটিলিভারের জন্য। সব ঠিক হয়ে যাবে। কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। এক সপ্তাহের ওষুধ দিলাম।’’

ওষুধ খেয়ে পটি আরো বেড়ে গেল। 
দিনে দশবার।
ডাঃ দাশ বললেন, ‘‘ভয় পাবেন না, যতবার হচ্ছে হোক।’ ’
যেন কোন রাজনৈতিক নেতা বলছে, ‘‘যত ইচ্ছে ওরা গুলি করুক, ভয় নেই।” তারপর ডাঃ স্যার চলে গেলেন এসকারসনে। যেন দেশের মন্ত্রী গেলেন বিদেশে।
সাতদিন পর পটি ধরল। পাকজঙ্গীরা যেন গুলি করে করে ক্লান্ত হল, ডাঃ দাশকে বললেন, ‘‘পটি ধরেছে। গ্যাসের ব্যাথাটা আছে বেশ?’ ’

‘‘আমি কলকাতায় ফিরলে আপনি আউটডোরে আসবেন।’’
তাই আজ দেখা করতে এসেছ সুদর্শন। কিন্তু স্যার কখন নামবে? একটা বাজতে চলল। বুকের মাঝেখানে অনুপ্রবেশ করছে গ্যাসের ব্যাথা পাকজঙ্গীদের মতো। এবার ছুটবে বুলেট, মানে তীব্র ব্যাথা উঠবে। ছুটতে হবে বাড়ির দিকে আত্মরক্ষার জন্য। উর্মির ওপর রাগ বাড়ছে। একটা ফোন করল, সেই রিংটোন, ‘ও মাঝিরে...’

“বেশ গান লাগিয়েছ তুমি। তোমার মাঝি এখন অসুখের নদীতে ভাসছে। হাবুডুবু খাচ্ছে।”

ফোন নীরব। সুদর্শন বুঝেছে, উর্মির ভালবাসা শীতের বিকেলের মতো ফুরিয়ে আসছে। আগে তার পাশে না শুলে ঘুম আসত না। এখন পাশের ঘরে একা না শুলে ঘুম আসে না। বহুদিন শরীর শরীরের সঙ্গে কথা বলে না। মানে ঘনিষ্টতা নেই। মানে যৌনতা নেই। মানে ভালবাসা নেই। অনাত্বীয় যেন। না হলে উর্মি বলতে পারে, “হলে হবে। কি করতে পারি?”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ। ফাইব্রোস্ক্যান পরীক্ষায় সিরোসিস অব লিভার ধরা পড়লে, তোমার কিছু করার নেই।’’
খুব শান্ত গলায় উর্মি বলেছিল, “হাজার হাজার ক্যানসার পেশেন্ট মারা যাচ্ছে। বাড়ির লোক কি করতে পারে?”

উর্মির এই রকম সন্ন্যাসিনী সুলভা কথা শোনার পর তার আর ক্যান্সার ভীতি ছিল না। আসলে মানুষ নিজের মৃত্যুর জন্য ভয় পায় না। সে দেখে সে ক্ষেত্রে তার মৃত্যুর জন্য কে কে কাঁদছে কেউ যখন কাঁদার থাকে না। তখন সেই মৃত্যু ভয়হীন হয়ে যায়। 


গ্যাসটিকের ব্যাথাটা এবার বাড়ছে। এক ঘণ্টার বেশি সে বাইরে কাজ করতে পারে না। এই গ্যাসের ব্যাথা তার শরীর মন জীবিকা সব ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে। ব্যাথাটা স্টমাক নামক বর্ডার ক্রোশ করে ঢুকে পড়ছে পাক জঙ্গীদের মতো বুকের মাঝেখানে। সে নিরস্ত্র সীমান্তবাসী।
সুদর্শন আর থাকতে না পেরে দোতলায় উঠে এল। সুপারেরর ঘরে চার পাঁচজন লোক। তারা কথা বলছে। মাঝে ঢুকে পড়ে বলে, ‘‘স্যার আমাকে একটু দেখে দিন। গ্যাসের ব্যাথা হচ্ছে মারাত্মক।’ ’

‘‘আপনি নিচে যান। আমি যাচ্ছি।’ ’

আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করল সুদর্শন। আর পারছে না। ক’দিন আগে কাশ্মীরে পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ের ওপর পাক জঙ্গীদের বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জন ভারতীয় সেনার। তারপর থেকে সীমান্তে চলছে লড়াই। সীমান্তের নিরস্ত্র গ্রামবাসীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ মারা যাচ্ছে। ভয়ে পালাচ্ছে কেউ কেউ। হ্যাঁ, এবার তাকে পালাতে হবে। ডাঃ দাশ উর্মিকে বলবেন, আপনার স্বামী রেস্টলেস। একটু অপেক্ষা করতে পারল না। কিন্তু ব্যাথাটা যে কি তীব্র সেটা কেউ বুঝতে চায় না। 
ডাক্তারই বলে, ‘‘এন্টাল গ্যাসটাইটিস! এ তো সামান্য ব্যাপার!” 

তখন সুদর্শনের মনে হয় সে যেন কাশ্মীর সীমান্তের গ্রামবাসীদের একজন। জঙ্গীরা ঢুকবে। মারবে। এটা সামান্য ব্যাপার। ডাক্তারদের মতো দেশের নেতারা বোঝে না সীমান্তের মানুষের কাছে এটা কতটা তীব্র যন্ত্রণার আতঙ্কের।
উর্মিকে ফোন করল সুদর্শন, উর্মি জানাল, ‘‘অপেক্ষা করতে হবে। তুমি কোন ভি. আই.পি. নও।’’

সুদর্শন বলল, ‘‘গ্যাসের ব্যাথায় মরে যাচ্ছি।’’

উর্মি কিছু বলল না, তার মনে হল, দীর্ঘ ৫-৬ বছর ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে কাজ করছে সে। ফাঁকা ছিল পাকস্থলী। অ্যাসিড দখল করেছে। ব্যাথা তো হবেই। 
স্বাধীনতার সময় স্বাধীন কাশ্মীর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছিল, কার সঙ্গে যাবে? 
ভারত না পাকিস্তান? 
এই ভাবনার অবসরে পাকিস্থানী সেনা অর্ধেক কাশ্মীর দখল করেছে। এখন বাকিটা চাই। তার জন্য জঙ্গীহানা। সেখানকার মানুষের ব্যাথা যন্ত্রণা তো হবেই। কেন যে তার অসুখের কথাটার সঙ্গে কাশ্মীরের ভাবনাটা এসে যাচ্ছে! আসলে চল্লিশটা তাজা প্রাণের মৃত্যু যন্ত্রণাটা তাকে তিলতিল করে দগ্ধ করছে, এখন যেমন তার বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে অ্যাসিডে। আর ডাঃ দাস সুপারের কাজ করে চলছে। পেশেন্টদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় রেখে তার কি সুপারের কাজ করা উচিত? সুদর্শনের হঠাৎ মনে হল এটা অনেকটা কাশ্মীরে সমস্যাটা ফেলে রেখে নেতারা অন্য কাজে ব্যস্ত। বিদেশ ভ্রমণ, বক্তৃতায়, ভাষণে ব্যস্ত।
না, আর অপেক্ষা করা চলে না। ডাঃ দাশ যাই ভাবুক, আর যাই বলুন উর্মিকে। এখন তাকে বাঁচতে বাড়ির দিকে ছুটতে হবে। ভাতের গ্রাস চালান করতে হবে খাদ্যনালী দিয়ে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। হার্টে চাপ দিচ্ছে গ্যাস।
সুদর্শন বেরিয়ে আসে। সাইকেলের লক খোলে, অরবিন্দ সরণি ধরে ছুটতে থাকে। অটোর সামনে দিয়ে, বাসের ধার ঘেষে বাইকের সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিয়ে ছুটেত থাকে। সুদর্শনের হঠাৎ মনে হয় এই ছোটা আসলে বাঁচার জন্য লড়াই, যুদ্ধ। কতদিন চলবে সে জানে না। শিশুরা যেমন রোজ খেলে, তাকেও রোজ যুদ্ধ করতে হবে। তার মানে যুদ্ধটা তার কাছে প্রতিদিনের খেলা, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা 
খাড়াই অরবিন্দ সেতুতে না উঠে তার পাশের রাস্তা ধরে চলে এলো ছোট্ট ব্রিজে। তারপর দ্রুত সাইকেলের চাকা বাজারের কাছে এসে পড়ল, তখনই মনে হল, হাসপাতাল যাবার সময়, এখানে দাঁড়িয়ে কে যেন বলছিল, কাশ্মীরে এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে।
পাড়ার গলিতে ঢুকে সুদর্শনের মনে পড়ল, চিৎকার করছিল পাগল সনাতন ছেলেটি।
-: সমাপ্ত :-



গল্পটি পড়ে আপনার যদি ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই পোস্টের নিচে কমেন্ট করে জানাবেন আমাদের। ব্লগে আরও নিত্য নতুন গল্প-কবিতা সকলের আগে পড়তে অলীক চেতনা পত্রিকা দপ্তরকে এখনই অনুসরণ করে রাখুন।
এখন নিচের শেয়ার অপশনগুলি থেকে শেয়ার করে অন্যদেরকেও পড়ার সুযোগ করে দিতে পারেন আপনি।

প্রকাশক : শৌভিক দে
প্রকাশনার তারিখ : ২৯ শে অক্টোবর, ২০২০

Souvik Dey

Hello. My name is Souvik Dey. I am a B.Tech. 3rd year student. I did my diploma in civil engineering and currently pursuing BTech in Computer Science. My team and I run this blog together. Don't forget to share these articles with your friends. Thank you.

2 Comments

Thank you for your valuable time.
We are fond of your comments.(but, do not spam)

  1. Anonymous4:38 AM

    গল্পের থেকেও আকর্ষণীয় লাগলো Website এর ডিজাইনটা।
    খুব সুন্দর presentation.

    ReplyDelete
  2. Anonymous4:40 AM

    দারুণ লাগলো ❤️

    ReplyDelete
Previous Post Next Post