“পান-সুপারি-সিন্দুর দিলাম দুহাত ভরে/
জনম্ জনম্ থাকো আমারই ঘরে।।”
সেই মা লক্ষ্মীকে ঘরে তুলতেই হোক আর ভুঁড়িভোজ সাবাড় করার পরেই হোক অথবা, মোড়ের মাথায় মাচার দোকানে বসেই হোক, বাঙালির পান সাজা না হলে কোনোদিনই জমে না! সুপুরি-পান, জর্দা-পান, এলাচ-পান, ঝাল পান, মিষ্টি পান....সে যে কত ধরনের পান আছে তার লিস্টি করা ভীষণই খাটুনির কাজ।
কিন্তু, কখনও কি শুনেছেন
“শামুক পান”
অবাক হওয়ার মত কিছুই না! আসলে আমাদের চিরপরিচিত চুন-পানেরই আসল নাম হলো গিয়ে শামুক পান।
শামুক এবং পান :
জানতে চান তো, কেন এমন নাম ? তাহলে চলুন আসল গল্পটা বলা যাক;
বহু প্রাচীনকাল থেকেই 'চুন' এর ব্যবহার করে আসছে মানুষ, কখনও খাদ্য হিসেবে, কখনও ঘা শুঁকোতে, কখনও বা জল পরিষ্কারে, আবার কখনও পরীক্ষাগারে। এই চুন তৈরীর এক আদিমতম উৎস হচ্ছে, শামুকের বা ঝিনুকের খোল।
বলা যেতে পারে, বহুকাল থেকেই চুন তৈরির কাজে শামুক বা ঝিনুকের খোল ব্যবহার হয়ে আসছে।
বিজ্ঞান এবং চুন :
বৈজ্ঞানিক যুক্তি অনুসারে, আসলে শামুকের খোলসে থাকে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যা একটি চুন প্রস্তুতকারক উপাদান। ক্যালসিয়াম কার্বনেটকে উত্তপ্ত করলে একটি নির্দিষ্ট তাপে তা বিয়োজিত হয়ে ক্যালসিয়াম অক্সাইড প্রস্তুত করে। এরপর সেটিকে জলের সাথে বিক্রিয়া করালে উৎপন্ন হয় ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড, যা পোড়া চুন হিসেবে আমরা ব্যবহার করে থাকি।
CaCO3 + heat = CaO + CO2
CaO + H2O = Ca(OH)2
CaO + H2O = Ca(OH)2
অবস্থান :
এমনই শামুক বা ঝিনুক থেকে চুন তৈরির কাজ করা হয়ে থাকে বাংলাদেশে অবস্থিত নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলাতে। সেই কারণে ওই অঞ্চলে বেশিরভাগ সময়ই আকাশে ধোঁয়া দেখা যায়। চুন তৈরির কাজটি করেন সেখানকার কিছু বাসিন্দা, যারা ভুঁইমালি নামে পরিচিত। এরা সাধারণত বংশ পরম্পরায় এই জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে বহুুকাল ধরে।
পদ্ধতি :
ভুঁইমালিরা অদ্ভুত এক উপায়ে চুন প্রস্তুত করে থাকে। গ্রামীণ এই পদ্ধতির চল দেখা যায় আরও অনেক জায়গায়। উল্লিখিত পদ্ধতিটি আসলে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে;
- সর্বপ্রথম যে কাজটি এক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে, সেটি হলো শামুক বা ঝিনুকের খোলসের জোগান দেওয়া।
- এরপর একটি বড়ো মাটির উনুনের মধ্যে যথাক্রমে ইঁট, কলসির ভাঙা টুকরো এবং ছোট ছোট করে কাটা কাঠ দেওয়া হয় স্তরে স্তরে।
- কাঠের উপর সামান্য আগুন দিয়ে তাতে ধোঁয়া বের করার পর সেখানে ধীরে ধীরে শামুকের খোল, তার উপর আবার কাঠ এবং সবশেষে আবার শামুকের খোল দিয়ে দেওয়া হয়।
- এরপর উনুনের নিচে একটি ছোট্ট গর্তের মধ্যে বাতাস করে আগুনের আঁচ বজায় রাখা হয়।
- খোলসগুলো পুড়ে গেলে, সেগুলোকে ঠান্ডা করে কুলোয় করে ঝাড়া হয়।
- সবশেষে পোড়া গুড়ো শামুক ও ঝিনুকের খোলসগুলো একটি গর্তের মধ্যে ফেলে, তাতে জল দিয়ে, ভালো করে দুরমুশ করা হয়। এভাবেই কিছু সময় দূর্মুশের পরে একেবারে সাদা ধবধবে চুন প্রস্তুত হয়।
চুন প্রস্তুত |
চুনের বাজার :
ভুঁইমালিদের কথায়, প্রায় ৬০ কেজি শামুকের খোল থেকে ১২০-১৫০ কেজি চুন তৈরি করা সম্ভব। বর্তমান বাজারে শামুকের খোলের দাম প্রচুর বৃদ্ধির কারণে (৩০০টাকা বস্তা) চুন প্রস্তুতকারিরা বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আবার জীবিকা পরিবর্তন করার চিন্তাও করছেন। বাংলাদেশের বাজারে ৬০০টাকা মণ চুনের পাইকারি দামটা না বাড়লেও কাঁচামালহিসেবে শামুকের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। তাই বলা যেতে পারে, চুনের এই ব্যবসা বর্তমান বাজারে অস্তাচলের দিকে।
অতএব, এই শিল্প এবং জীবিকা বাঁচাতে বেশি বেশি করে শামুক পান নিজে খান আর লোককেও খাওয়ান। ওই যে গানের ভাষায় বলে না;
ও খাইকে পান বেনারসওয়ালা!খুলি যায়ে বান্দ আকল কা তালা!
Tags:
News
হ্যাঁ তাই তো এই ব্যাপারটা অনেকে জানেনা। বলতে গেলে আমি ও জানতাম না বা এটা নিয়ে কোনো দিন ভাবা হয়নি। আজকেই জানলাম ।
ReplyDeleteবাপরে.....
ReplyDelete