মনসাপূজোয় পাঁঠাবলি কি শাস্ত্রসম্মত ? || বেদ কি বলছে !


 মিশরীয় সভ্যতার ন্যায় ভারতবর্ষের ইতিহাসেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পশুপাখিকে আরাধনা করার চল ছিল, যা বর্তমানকালেও যথেষ্ট প্রচলিত। এই পশুপাখিদের মধ্যে সর্পজাতির পূজাও একটি প্রাচীনতম অনুষ্ঠান। সাপের দেবীরূপে বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে মা মনসা পূজিত হয়ে থাকেন মূর্তিরূপে। তাঁকে মূলত লৌকিক দেবীকূলের অংশ হিসেবেই আরাধনা করা হত প্রাচীনকালে, পরবর্তীতে অবশ্য পৌরাণিক দেবীরূপে স্বীকৃত পান তিনি। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে (৩২ তারিখ) হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনেকের ঘরেই মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
চৈতন্যদেবের সময় থেকে বাংলাদেশে, মাটির প্রতিমা গড়ে ঘটা করে মনসা পূজা করার চল ছিল।

<marquee><b>Img. Loading...</b></marquee>
মাতৃরূপে পূজিত মা মনসা

মনসা পূজার ধরন-ধারণ :

লোকসমাজে পূজা সাধারণত দুভাবে হয়ে থাকে। 
  • কোনো কোনো পূজায় পাঠা বলি দেওয়া হয়। 
  • আবার কোনো কোনো স্থানে পাঁঠাবলি ছাড়াও পূজা করা হয়ে থাকে।
তবে বর্তমানে আইনি জটিলতা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে আর বলিপ্রথার চল বিশেষ চোখে পড়ে না।
আমরা মনসা পূজার প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করে থাকি বহুক্ষেত্রে, প্রতিমা বিচারেও এই পূজার শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে।
  •  কেউ কেউ মাতৃরূপে প্রতিমা বানিয়ে পুজো সম্পন্ন করে থাকেন। 
  • আবার কেউ পঞ্চসর্পের ফণাযুক্ত প্রতিমার পূজা করেন। 
  • আবার কখনও কখনও কেবল ঘটপুজো করা হয়ে থাকে।
গোত্র ও অঞ্চলভেদে প্রথার উপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন।


মা মনসার উত্থান :

'মনস্' শব্দের পরে স্ত্রীলিঙ্গের ‘আপ্’ প্রত্যয় যোগ করে ‘মনসা’ শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘মনসা’ মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। 
‘দেবী ভাগবত’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্ত’ পুরাণ মতে, সর্পভয় থেকে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য ব্রহ্মা, কাশ্যপ মুনিকে মন্ত্র বা বিদ্যা বিশেষ আবিষ্কারের জন্য আদেশ করেন। ব্রহ্মার আদেশে কা মুনি যখন মনে মনে এ বিষয়ে চিন্তা করছিলেন তখন তাঁর মননক্রিয়ার সাকার রূপ পরিগ্রহ করে এক মহাদেবী দীপ্যমান হন। তিনটি কারণে এই মহাদেবীর নাম হয় ‘মনসা’।
  • প্রথমত, কাশ্যপ মুনির মানস কন্যা, 
  • দ্বিতীয়ত, মনুষ্যগণের মনই তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্র, 
  • তৃতীয়ত, তিনি নিজেও মনে মনে বা যোগবলে পরমাত্মার ধ্যান করেন। 
দেবীর দ্বাদশটি নাম আছে : জরৎকারু, জগদ্গৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী, নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা।


বনের আগুন থেকে মনের আগুন ভয়ংকর : “হিংসুক জ্বলে মরে হিংসার আগুনে”, জ্ঞানীদের এই চিরন্তণ বাণী, চিরসত্যকে সামনে রেখে আমরা আমাদের আত্মপ্রেম দিয়ে জগতের কল্যাণ বয়ে আনতে পারি। প্রেমময় স্রষ্টার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে, যখন প্রেম পূজার রূপ নেয়, তখন পৃথিবী হয়ে ওঠে আলোকজ্জল শান্তির আধার। পদ্ম-পুরান বা মনসা-মঙ্গল কাব্যে তাই তুলে ধরা হয়েছে।


(দেবী মনসা। জগৎকারু মুনিপত্নী ও আস্তিক মুনিমাতা, পৌরাণিক তথ্য সূত্রে জানা যায় যে, দেবী মনসা কশ্যপ মুনির মনোচিন্তা হইতে আবির্ভূত তাই তাঁকে কশ্যপ মুনি মনসা নামকরণ করেন এবং সেই কন্যা লালিত পালিত লক্ষ্যে বাসুকিনাগের হাতে সমর্পণ করেন। তথাকথিত বাসুকিনাগ দেবী মনসাকে পাতালে নিয়ে যায় এবং ভগ্নিতুল্য লালন-পালন করেন, এমনকী দেবী মনসা সর্পজাতির ভগ্নি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। 

আবার অন্য পৌরাণিক তথ্য সূত্রে জানা যায় যে, দেবী মনসা দেবাদিদেব শিবের কন্যা রূপে আবির্ভূত হন। শিবকন্যা নামে খ্যাতি অর্জন করেন কিন্তু কিভাবে নাগলোকে অধিষ্ঠিত হন তাঁর অস্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর! এতটুকুই জানা যায় যে, তিনি শিবকন্যা অর্থাৎ শিবাঙ্গী।

যদি পৌরাণিক তথ্য প্রকৃতপক্ষে বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেবী মনসার বৃত্তান্ত সন্দেহাতীত! এমনকী, যাঁর পূজার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর।)


মা মনসা লৌকিক দেবীরূপে অতি প্রাচীনকালে বিশেষ করে গুপ্ত রাজত্বে বাংলাদেশে আর্য-উপনিবেশ স্থাপিত হয়। আর্যরা ছিলেন চিন্তাশীল, আদর্শবাদী, সংযমনিষ্ঠ ও আধ্যাত্মপরায়ণ। তারা দেবসেবা ও সজ্ঞানুষ্ঠান করতেন। সে সময় একেক জন একেক শ্রেণির দেব-দেবীর পূজা করতেন। কেউ বৈদিক, আবার কেউ পৌরাণিক। অষ্টম শতকে পাল রাজগণ বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। এ সময় বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে সেন রাজাগণের আমলে শৈব, বৈষ্নব, বৌদ্ধতান্ত্রিক, ব্রাক্ষ্রণ্য প্রভৃতি ধর্মমত প্রচলিত হয়। এতে করে উপাসকদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে শুরু করে।
<b>Img. Loading....</b>
National museum, New Delhi

দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় তূর্কী আগমন শুরু হয়। এসময় বাংলার পলিমাটিতে নবরূপায়ণ হয়। হিন্দু সনাতন ধর্মের লৌকিক দেবী মনসার পাঁচালী, অপৌরানিক পাঁচালী হিসেবে গড়ে ওঠে। সেখানে শৈব / শিব উপাসক চাঁদ সওদাগর মনসার বিরোধী ছিলেন। চাঁদ সওদাগর মনসা পূজা না করলে মানবকূলের কেউ মনসা পূজা করবে না। এ নিয়ে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয় মনসার সাথে। সেই বিরোধে জেদ ধরে মনসা একে একে চাঁদের ছয় ছেলেকে সাপ দিয়ে দংশন করায়। ছয় বিধবার পুত্রবধূ নিয়ে চাঁদ সওদাগর মনসার প্রতিহিংসার শিকার হন। সাগরে তাঁর চৌদ্দটি বাণিজ্য ডিঙ্গি ডুবে যায়, চাঁদ সওদাগর প্রাণে বেঁচে রইলেন মাত্র। কিন্তু, তারপরও তার হিংসা দূর হলো না।

এদিকে, মনসা তার পূজা লাভের আশায় স্বর্গের অনিরুদ্ধ ও ঊষাকে মত্ত্যালোকে নিয়ে এলেন যথাক্রমে চাঁদপুত্র লক্ষিণদর রূপে এবং সায়বেনের মেয়ে বিপুলা রূপে। বাসর ঘরে সর্প দংশনে লক্ষিন্দরের মৃত্যু হয়। স্ত্রী বিপুলা মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেলা যোগে স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তিনি সতীত্বের বলে স্বামীকে পূণজীবিত করেন, ছয় ভাসুর এবং চৌদ্দ বাণিজ্য ডিঙ্গি নিয়ে মর্তে ফিরে আসেন। সবার অনুরোধে পরিশেষে চাঁদ সওদাগর বামহাতে মনসা দেবীর পূজো করেন। লক্ষীন্দর ও বিপুলা শাপ মুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে যায়।

চমৎকার এ কাহিনী নিয়ে সুকবি নারায়ণ দেব ও পন্ডিত জানকীনাথ পদ্মপুরান লিখেছেন। যা পৌরানিক কাব্য হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। অতঃপর, লৌকিক দেবী পৌরাণিক দেবীর আসন দখল করে নিয়েছেন। 



পদ্মপুরান বা মনসামঙ্গল কাব্যে দু’টি অংশ রয়েছে। প্রথম খন্ড ‘দেবখন্ড’ এবং পরের খন্ড ‘বানিয়াখন্ড’। হর্ষয়নের পর পঞ্চমী তিথিতে মনসা পূজা বিধেয়। তবে, বাংলাদেশ ও ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গে শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতেই মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো স্থানে এক মাসব্যাপী মনসা মঙ্গল কাব্যগীতি গান হয়।

মনসামঙ্গল রচায়িতাদের মধ্যে কানা হরিদত্ত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, রচনাকাল ১২ - ১৩ শতক। এছাড়া, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই , ক্ষেমানন্দ, নারায়ণদেব প্রমুখ। এরপর ষোড়শ শতকে দ্বিজবংশী দাসের মনসা মঙ্গল, এখানে বিপুলা (বেহুলা) সিথির সিঁদুর মুছতে পারেনি কাল নাগ। চাঁদ সওদাগরের হিংসা-ঘৃণা পরিশেষে প্রেম পূজায় রূপ নিয়েছে এ মনসামঙ্গল কাব্য। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আমরাও প্রেমকে পূজা এবং পূজাকে সেবার রূপে রূপায়িত করে আমাদের কল্যাণময় দেশ গড়তে পারি।
<b>Img. Loading....</b>
মনসামঙ্গল


আক্ষরিক অর্থ :

‘মনসা’ শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘মনে চিন্তন’।
কিন্তু, দেবীরূপে মনসা কি চিন্তনের কোন বিষয়?
মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়, মননকে সুখশ্রাবী করার জন্য মন্ত্রের উদ্ভব। মন্ত্রই মনকে ঊর্ধ্বগামী করে। সেই মন যদি বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তবে তো সমগ্র দেহই বিষাক্ত হয়ে যাবে। 
তাই, মনসার উৎপত্তি যেমন আর্যঋষিগণ দেখিয়েছেন বিষহরী দেবীরুপে, সেরূপ বিষভরণ করে মনকে বিষযুক্ত করারও ব্যবস্থা তার হাতে। সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু, নিজে যখন খায় তাতে বিষ লাগে না। কিন্তু , হিংসায় বা আত্মরক্ষায় যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনের বিষ হলো হিংসা, ক্রোধ, লোভ। আর এগুলো দূর করার দেবী হলেন মা মনসা। চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই; তবু চিন্তা যাতে মুক্ত হতে পারে, চিন্তা যাতে রিপুর বশ না হয় তারই চেষ্টা আমাদের করতে হবে, এই শিক্ষাই দিয়েছেন দেবী মনসা।

দেবীর বাহন :
মা সরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহনও কিন্তু হংস। বাহনকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, মনসাও জ্ঞানযুতা এবং জ্ঞানলক্ষণা। দেবী মনসার জ্ঞানশক্তি মনোময়। শুদ্ধযোগ ও আধ্যত্মজ্ঞানের সাধনসিদ্ধি দেবী মনসারই দান।

তিথী ও পূজার চল :

আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর যে পঞ্চমী তিথি (শ্রাবণ) আসে, তাকেই ‘নাগপঞ্চমী’ বলে। নাগপঞ্চমীতে উঠানে ‘সিজগাছ’ স্থাপন করে মনসাপূজা করা হয়। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী পর্যন্ত পূজা করার বিধান আছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে পুরো একমাস যাবত্ পূজা করা হয় এবং পূজা সমাপনান্তে বিশেষ পুজো করা হয় অথবা, শুধুমাত্র শেষ দিনে পুরোহিত দ্বারা পূজা করা হয়।
দেবী মনসার বিভিন্ন কীর্তি মনসা পুঁথিতে বর্ণিত রয়েছে। মনসা পূজার আগে প্রায় একমাস ধরে এ পুঁথি পাঠ করেন হিন্দু নারীরা। অনেক স্থানে পালাও পরিবেশিত হয়।


পশুবলী প্রথা :

শ্রীমদ্ভাগবতের (৪/১৯/৩৬) শ্লোকের ব্যাখ্যা এইযে,-

মা কালী হলেন শিবের সাধধী স্ত্রী। তিনি শিবের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেন। শিব নিরামিষাশী এবং প্রসাদভোজী। তাই, মা কালী কখনো আমিষাশী নন।

শিব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব। তিনি বিশেষ কৃপা করে ভূত-প্রেত-পিশাচদেরও আশ্রয় দিয়েছেন। তেমনই মা কালী যক্ষিণী ও ডাইনীদের আশ্রয় দিয়েছেন।

এই শ্রেণীর প্রাণীরা জগতে যাতে বেশী উৎপাত না করে, সেইজন্যে রক্তমাংস হাড় ভক্ষণের প্রবল প্রবণতাকে সংযত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। পিশাচগুণসম্পন্ন মানুষদের জন্যে, অমাবস্যার গভীর রাতে মহামায়ার উগ্ররূপা কালীমূর্তির সামনে পাঁঠা বলি দিয়ে তার মাংস ভক্ষণ করানোর ব্যবস্থা করা হয়। শাস্ত্রের এই বিধান মাংসাহার নিয়ন্ত্রণেরর জন্যেই। কালক্রমে, নানাভাবে লোকে বলিপ্রথার দোহাই দিয়ে অসংখ্য প্রাণী হত্যা করতে থাকলে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বুদ্ধরূপে আবির্ভূত হয়ে বলি প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

আসুরিক প্রবৃত্তির মানুষেরা জাগতিক লাভের জন্যে কালীর পুজো করে। কিন্ত, তাদের সেই পূজোর নামে তারা যে পাপ করে, তা থেকে তারা অব্যহতি পায় না আমৃত্যু পর্যন্ত।

<b>Img. Loading....</b>
একটি নৃশংস বলির দৃশ্য


মা মনসার পূজোর ক্ষেত্রে বলিদানের বিষয়ে বলা হয় যে, পূজার মূল প্রতিপাদ্য হল মা মনসার উদ্দেশ্যে পাঁঠা (মর্দ ছাগল) বলির মাধ্যমে মানুষের মনের পশুকে দমন করা। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, 

যদি মানুষের মনের পশুত্বকে নিরীহ প্রাণী হত্যার মধ্য দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে, পরের বছর আবারও নিরীহ জীব বলি দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে কেন?


আজকের দিন :

আজ মনসা পূজো। প্রতি বছরের মত এবারও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পাঁঠা বলির মাধ্যমে মনসা পূজা উদযাপন করা হচ্ছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সকালে দেবীর সাদা পূজা সম্পন্ন করা হয়েছে এবং পরে ভক্তদের মাঝে প্রদান করা হয় অঞ্জলি। এরপর শুরু হয় পাঁঠা বলি।



বলি বিরোধীতা :


মা মনসা পূজোর দিন সনাতনী সমাজ বা বিশেষত সনাতনী নারীরাই এই পূজা পালন করে থাকেন। এই দিনে সনাতনী নারীরা নাগকুন্ডের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে এবং নাগকুন্ডের উপরে আবির ছিটিয়ে নাগকুন্ডকে অলঙ্কিত করেন ও নাগকুন্ডের মুখ দিয়ে দুধ ঢেলে দিয়ে নাগজাতিকে সেবা প্রদান করেন। যেই প্রথা এখনও ভারতে বঙ্গরাজ্য ব্যতীত সকল রাজ্যের মধ্যে প্রচলিত।

 ১৩৯৪ ক্রিষ্টাব্দ পশ্চিমবঙ্গের সুনামধন্য কবিয়াল ও কাব্যগ্রন্থ লেখক কবি ক্ষেমানন্দ দাস সর্বপ্রথম দেবী মনসার লীলা বৃত্তান্ত তুলে ধরেন তাঁর মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রেন্থর মধ্যে দিয়ে। তিনি তাঁর লেখা মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে বেহুলা, লক্ষ্মীন্দর, চন্দ্রধর ও দেবী সনকা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য কথা তুলে ধরেন।

কবি ক্ষেমানন্দ দাস তাঁর মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে এতকিছু উল্লিখিত করেছেন কিন্তু, তিনি সেইসব তথ্যের কোনো প্রকার পৌরাণিক আখ্যা দাবি করেননি। এমনকী, কোনোপ্রকার পৌরাণিক তথ্য বলে সনাতনী সমাজের উপর চাপিয়ে দেননি। তাই হয়তো, বর্তমান সনাতনী সমাজে মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে।

সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়টি হলো মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দেবী মনসাকে ‘বলি’ প্রদানের কোনোপ্রকার কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র দেবী মনসার বৃত্তান্ত ও পূজা প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। পূজাপ্রাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন প্রকার মনোমুগ্ধকর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

আবার, সেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থটি পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত আসতে আসতে তা পরিবর্তন হয়ে নতুন আঙ্গিকে বাইশকবি পদ্মপুরাণ মনসাপুঁথির নাম ধারণ করে ১৫৯৯ শকাব্দ / ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দতে। আর এই কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা বাইশজন কবির নাম হলো:- (১) অনুপচন্দ্ৰ (২) কমলনয়ন (৩) কেতকা দাস (৪) গোপীচন্দ্র (৫) গোবিন্দ দাস (৬) জানকী নাথ (৭) নারায়ণ (৮) বংশীধন (৯) বংশী দাস (১০) বলরাম দাস (১১) বল্লভ দাস (১২) দ্বিজবলরাম (১৩) বিজয় গুপ্ত (১৪) বৈদ্য জগন্নাথ (১৫) যদুনাথ (১৬) রঘুনাথ (১৭) রমাকান্ত (১৮) রাধাকৃষ্ণ (১৯) রামনিধি (২০) সীতাপতি (২১) হরিদাস (২২) হৃদয়।

সেখানে বেহুলার সাথে লেখা হয় মা মনসার জন্মবৃত্তান্তও। এমনকি এখানে উল্লেখ করা হয় যে, মা মনসা চাঁদ সওদাগরকে ৯ দিনে ৯টি পাঁঠা বলি দিতে বলেছেন। 
যেখানে সনাতনী সমাজ, দেবী মনসাকে বলি প্রদানের লক্ষ্যে একদিনের জন্য লক্ষ টাকার পাঁঠা ক্রয় করে, সেখানে যদি নয় দিনে নয়টি পাঁঠা ক্রয় করতে হয় তাহলে, সনাতনী সমাজ দেবীকে পাঁঠা বলি না দিয়ে জলজ্যান্ত নরবলির বলির প্রথা আবার শুরু করে এক পর্যায়ে নিজ সন্তানকেও হয়তো বলি প্রদান করে মায়ের প্রতি উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করবে না।

আবার, মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত মহাভারত গ্রন্থের আদিপর্বে দেবী মনসার বৃত্তান্ত পাওয়া যায়, আর সেই ঐতিহাসিক ইতিহাসটি হলো- অর্জুনপুত্র অভিমন্যু, অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিত, পরীক্ষিত পুত্র জনমেজয় আর এই জনমেজয় যখন তাঁর পিতার (অর্থাৎ পরীক্ষিত) তক্ষকনাগ কতৃক মৃত্যুর রহস্য জানতে পারে, তখন রাজা জনমেজয় সর্পসত্র নামক এক যজ্ঞের আয়োজন করে।

সেই যজ্ঞেতে মন্ত্রের শক্তিতে ব্রহ্মাণ্ডের সকল নাগজাতি এসে ভস্মীভূত হতে থাকে, এই হেন পরিস্থিতি দেখে সকল নাগজাতি সর্পরাজ বাসুকিনাগের স্মরণাপন্ন হয় এবং উপায় খুঁজিতে সর্পরাজ বাসুকিনাগ ভগ্নি দেবী মনসার স্মরণাপন্ন হয়। তাঁদের দু'জনের আলাপচারিতা শুনে অস্তিক মুনি সর্পসত্র নামক যজ্ঞের সমাপ্তি করার আশ্বাস প্রদান করে এবং অস্তিক মুনি রাজা জনমেজয় হইতে বরলাভ করে জনমেজয়ের সর্পসত্র যজ্ঞ বন্ধ করেন।

এছাড়া অত্র মহাভারতের আদিপর্বে আরো কিছু পূর্বে জগৎকারু মুনি তাঁর পূর্বপুরুষের সহিত সাক্ষাৎ হয় এবং পূর্বপুরুষদের উদ্ধার লক্ষ্যে তিনি সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন। তাঁর পর তিনি পাণিগ্রহন করিবার লক্ষ্যে দ্বারপরিগ্রহ (দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেন) করেন, কিছু সময় পর সর্পরাজ বাসুকিনাগ সেই সংবাদ শুনে জগৎকারু মুনিকে অন্বেষন করেন ভগ্নিদানের লক্ষ্যে।

এক সময় জগৎকারু মুনির সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার পর সর্পরাজ বাসুকিনাগ জগৎকারু মুনিকে তাঁর ভগ্নিদান করার আশা ব্যক্ত করেন এবং জগৎকারু মুনিকে নিয়ে গিয়ে বাসুকিনাগ, দেবী মনসাকে জগৎকারু মুনির হাতে সমর্পণ করেন আর জগৎকারু মুনি দেবী মনসাকে একটি শর্তসাপেক্ষে তাঁর পাণিগ্রহন করেন। এই ছাড়া দেবী মনসার পূজার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

<b>Img. Loading....</b>
নাটকের পর্দায় বেহুলা-লক্ষীন্দর


তথা কথিত এইসব গ্রন্থে দেবী মনসা কিভাবে স্বর্গের দেবীত্ব অর্জন করলো এবং কিভাবে পূজার অধিকার প্রাপ্তি করলো তাঁর কোনো ইতিহাস বা তথ্য নেই। কিন্তু, এই দু'টি কাব্যগ্রন্থ মনসামঙ্গল ও বাইশকবি পদ্মপুরাণ মনসা পুঁথিতে মনসার জন্ম বৃত্তান্ত, লীলা বৃত্তান্ত, পূজা বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। বিস্ময় লাগে এই কিছু কবিয়াল কাব্যগ্রন্থ লেখক কোথা থেকে চন্দ্রধর, সনকা, বেহুলা লক্ষ্মীন্দর খুঁজে পেলো? যে ঐতিহাসিক ইতিহাসটি সনাতনী কোনো গ্রন্থের মধ্যে পাওয়া যায় না!
সুতরাং, এই গ্রন্থকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থে পড়া যেতে পারে কিন্তু, পুজো আচারের মত সামাজিক কার্যকলাপে একেবারেই মানা যায় না।

তবে এটুকু ভেবে দেখেছেন, কিছু কবিয়ালের লেখা বই পড়ে আজ সনাতনী সমাজ নিজেদের ধর্ম পালন করছেন! এমনকী, নিজেরা এতই অন্ধকারে প্রবেশ করেছে যে, ধার্মিক হতে গিয়ে কিছু কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তির লেখা গ্রন্থের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অবিদ্যায় (অর্ধম) জড়িত হয়ে পড়ছেন। আপনাদের চক্ষু উম্মোচন করার লক্ষ্যে কিছু তথ্য সূত্র তুলে ধরছি।

আমাদের সনাতন ধর্মের গ্রন্থের মধ্যে পশুবধকারীর পাপের জন্য বহু তথ্য আছে। কিন্তু, আজ অন্য কোনো গ্রন্থের তথ্য না দিয়ে সনাতনী সর্বপ্রাচীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বেদের জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক উপনিষদ থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরছি।

<b>Img. Loading....</b>
The Vedas

আমাদের বেদের জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক উপনিষদ বলছে যে,

প্লবা হ্যেতে অদৃঢ়া যজ্ঞরূপা
অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কৰ্ম্ম।
এতচ্ছ্রে য়ো যেহভিনন্দন্তি মুঢ়া
জরামৃত্যুং তে পুনরেবাপি যন্তি॥
(মুন্ডকোপনিষদ-২/৭)-

অনুবাদ : “এই যে অষ্টাদশ ঋত্বিকসাধ্য যজ্ঞরূপ প্লব (সংসার-সাগরোত্তরণের ভেলা) যাহাতে হীনফলপ্রদ কর্ম উক্ত হইয়াছে, ইহা দৃঢ়তর নহে - বিনাশশীল। যে সকল মুঢ়ব্যক্তি ইহাকেই শ্রেয় বলিয়া আদর করে, তাহারা পুনর্ব্বার জরা ও মৃত্যু লাভ করে (মুক্ত হইতে পারে না)।।” 

মুন্ডকোপনিষদ-২/৭-

অবিদ্যায়ামন্তরে বর্ত্তমানাঃ
স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতম্মন্যমানাঃ।
জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিয়ন্তি মূঢ়া
অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ
মুন্ডকোপনিষদ২/৮-

অনুবাদ : “অবিদ্যামধ্যে বাস করে, সুতরাং আপনিই আপনাকে ধীর ও পণ্ডিত বলিয়া মনে করে এবং রোগাদি অনর্থরাশি দ্বারা বারবার অতিশয়রূপে পীড্যমান মূঢ় ব্যক্তিরা অন্ধপরিচালিত অন্ধের নায় (উদভ্রান্তভাবে) ভ্রমণ করে॥

মুন্ডকোপনিষদ ২/৮-

অবিদ্যায়াং বহুধা বৰ্ত্তমানা বয়ং
কৃতার্থা ইত্যভিমন্যন্তি বালাঃ।
যৎ কর্ম্মিণো ন প্রবেদয়ন্তি রাগাৎ
তেনাতুরাঃ ক্ষীণলোকাশ্চ্যবন্তে॥

মুন্ডকোপনিষদ ২/৯-

অনুবাদ : “নানাপ্রকারে অবিদ্যার অভ্যন্তরে অবস্থিত, বালকগণ (মূঢ়গণ) অভিমান করিয়া থাকে যে, “আমরা কৃতার্থ হইয়াছি’’। যেহেতু কৰ্ম্মাসক্ত ব্যক্তিরা ফলাসক্তিবশতঃ (প্রকৃত ত্বত্ত) জানিতে পারে না, সেইহেতু স্বৰ্গাদি লোক ভোগ শেষ হইলে দুঃখার্ত্ত হইয়া সেই লোক হইতে চ্যুত হইয়া থাকে॥

মুন্ডকোপনিষদ ২/৯-

ইষ্টাপূর্ত্তং মন্যমানা বরিষ্ঠং
নান্যচ্ছ্রে য়ো বেদয়ন্তে প্রমূঢ়াঃ।
নাকস্য পৃষ্ঠে তে সুকৃতেহনুভূত্বে-মং
লোকং হীনতরং বা বিশন্তি।।
মুন্ডকোপনিষদ২/১০-

অনুবাদ : “অত্যন্ত মূঢ়গণ  ইষ্ট ও পূর্ত্ত কৰ্ম্মকেই সর্বশ্রেষ্ট মনে করিয়া থাকে ; অপর শ্ৰেয়ঃ আছে বলিয়া জানে না। তাহারা পুণ্যলব্ধ স্বৰ্গপৃষ্ঠে কৰ্ম্মফল অনুভব করিয়া এই লোকে কিংবা ইহা অপেক্ষাও অপকৃষ্ট (নরক হইতে অধিকতর নিম্নলোক) লোকে প্রবেশ করে॥” 

মুন্ডকোপনিষদ২/১০-

তপঃশ্ৰদ্ধে যে হ্যুপবসন্ত্যরণ্যে,
শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষচৰ্য্যাং চরন্তঃ।
সূৰ্য্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্ৰয়ান্তি
যত্রামৃতঃ স পুরুষো হব্যয়াত্মা॥
মুন্ডকোপনিষদ ২/১১-

অনুবাদ : “ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনপূর্বক অরণ্যে বাস করতঃ যে সমস্ত সংযতেন্দ্রিয় বানপ্রস্থ্য ও সন্ন্যাসী এবং জ্ঞানসম্পন্ন যে সকল গৃহস্থ তপস্যা ও শ্রদ্ধার সেবা করেন, তাহারা সূর্য্য দ্বারা অর্থাৎ উত্তরায়ণ পথে- যেখানে সেই অব্যয় স্বরূপ অমৃতপুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন, সেখানে গমন করেন।।

মুন্ডকোপনিষদ ২/১১-

তাহলে দেখুন আজ সনাতনী সমাজ যে ধর্ম তথা প্রথা পালন করছে তা পরিপূর্ণ রূপে অবিদ্যা! যাঁর কোনো প্রকার অস্তিত্ব সনাতন ধর্মের গ্রন্থ ও শাস্ত্রের মধ্যে নেই এবং সনাতনী গ্রন্থ তাঁর অনুমোদন দেয় না, তাঁরই এক দৃষ্টান্ত প্রমাণ তুলে ধরলাম বেদের জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক উপনিষদ থেকে।
হে সনাতনী সমাজ, তো
তোমাদের আত্মা যদি মাংসের স্বাদ পেতে চায়, তোমরা যদি নিজের তুষ্টির জন্য মাংস ভক্ষণ করতে চাও, তাহলে করো! কিন্তু, তা ধর্মের দোহাই দিয়ে নয়। কেননা মাংস ভক্ষণের পাপ হয়তো বা মোছণ করতে পারবে কিন্তু, অবিদ্যাজনিত পশুবলি বা পশুবধ অপরাধ স্বয়ং পরমব্রহ্ম পর্যন্ত ক্ষমা করবে না, কারণ যেই রেফারেন্সগুলি তুলে ধরা হয়েছে তা সেই পরমব্রহ্মের প্রাপ্তি জ্ঞানকাণ্ড নামক উপনিষদ থেকেই। তাই লোককথিত পূজা নামক অবিদ্যা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি সম্পূর্ণ সনাতনী সমাজকে।

বিঃদ্রঃ- লোক কল্পিত গ্রন্থ ও লোক সংস্কৃতি ধর্ম বর্জন করে নিজের জ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করা, সনাতন ধর্মের গ্রন্থ প্রণেতা মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত গ্রন্থ পড়া ও ওনার দেওয়া পদ্ধতিতে ধর্ম পালন করার অভ্যাস করুন এবং অন্যের ক্ষতিসাধন করে নিজেরা উৎসবে মেতে ওঠা পরিত্যাগ করুন; এই অনুরোধ থাকলো সকল পাঠকবন্ধুদের কাছে।

জীবে প্রেম করে যেই জন /
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
স্বামী বিবেকানন্দ -
Souvik Dey

Hello. My name is Souvik Dey. I am a B.Tech. 3rd year student. I did my diploma in civil engineering and currently pursuing BTech in Computer Science. My team and I run this blog together. Don't forget to share these articles with your friends. Thank you.

Post a Comment

Thank you for your valuable time.
We are fond of your comments.(but, do not spam)

Previous Post Next Post