আপনি কি জানেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৬ই আগস্ট এক স্মরনীয় দিন ?
আজ থেকে ১১৫ বছর পূর্বে এই দিনটিতেই আরও একবার উদযাপিত হয়েছিল ‘রাখিবন্ধন’ অনুষ্ঠান। ১৯০৫ সালে ১৬ই আগস্ট বঙ্গভঙ্গের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এমন ভাবেই ভাতৃত্বের উৎসবের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করার ডাক দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
তৎকালীন বছরের এই দিন, ১৬ আগস্ট অর্থাৎ ১৯০৫ সালের ১৬ই আগস্টের কয়েক দিন আগেই সেই সময়ের ব্রিটিশ শাসিত ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ‘বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব’ উত্তাপণ করেন। বাস্তবে এই সিদ্ধান্তের আড়ালে কাজ করেছিল ব্রিটিশদের এক ঘৃন্য উদ্দেশ্য!
সে সময় ভারতে স্বাধীনতার জন্য লড়াই মূলত চালিত হতো বাংলার মানুষের হাত ধরে, বাংলার বিপ্লবী স্বদেশি আন্দোলনে আন্দোলিত ছিল পুরো দেশ। ব্রিটিশরা তখন সমগ্র বাংলা প্রদেশের মেরুদণ্ড ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কাজে হাতিয়ার করে বাংলার ধর্মীয় সম্প্রীতিকে, বিবাদ তৈরি করা হয় হিন্দু-মুসলিম ভাইদের মধ্যে।
দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষীদের মন্ত্র-দীক্ষা-গানে উদ্দীপ্ত বাংলার বিদ্রোহের অগ্নিশিখায় ধীরে ধীরে প্রজ্জ্বলিত এবং আন্দোলিত হচ্ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষ। যা সুচতুর ইংরেজ শাসকরা ইতিমধ্যেই বুঝে গেছিল হাড়ে হাড়ে। আর সে কারণেই ‘বঙ্গভঙ্গ’-এর নামে প্রস্তাবিত হয় এই ষড়যন্ত্রের বিল। এর বিরুদ্ধে সারা বাংলা সেদিন প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছিল। আবার কাকতালীয়ভাবে এই প্রস্তাবটিকে ভাইসরয় লর্ড কার্জন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ করিয়েছিলেন যে দিন, সে দিনটা ছিল ১৯০৫ সালের ‘রাখিপূর্ণিমার’ দিন, যা বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে এক অপাড় ভাতৃত্ববোধে মিলনের দিন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এগিয়ে এলেন বঙ্গভঙ্গ আইনের প্রতিবাদে। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, পারসি, বৌদ্ধ-সহ বাংলার মানুষকে আহ্বান জানিয়ে লিখলেন গান,
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল /
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান..রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ১৯০৫ সালের ১৬ আগস্ট আবার পালিত হয়েছিল ‘রাখিবন্ধন’। সে দিন বাংলার ঘরে ঘরে হয়েছিল অরন্ধন, তখনকার ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা-সহ গ্রামেগঞ্জের বিভি্ন্ন মানুষজন পথে নেমে পড়েছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে।
কলকাতায় উপস্থিত সকল ধর্মের মানুষ সেদিন রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে রাখি পড়িয়ে ভাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধেছিলেন পরস্পরকে, উচ্চারিত হয়েছিল মৈত্রী-সম্প্রীতির উদার আহ্বান। সেই রাখিবন্ধন উপলক্ষে আয়োজিত পদযাত্রা পরিক্রমা করা হয়েছিল সমগ্র হ্যারিসন রোড (এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোড)। সেদিন পথ পরিক্রমা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত হয়েছিলেন কলকাতা তথা ভারতের বিখ্যাত নাখোদা মসজিদ-এর কাছে। মসজিদের ইমামসাহেব সে দিন বেরিয়ে এসে কবিগুরুকে সালাম-প্রণাম জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ইমামসাহেবকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার মাধ্যমে এবং পরস্পরকে রাখি পড়ানোর মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলিম ভাতৃত্বতাকে আরো শক্ত বন্ধনে বেঁধে দেন। পদযাত্রায় স্বয়ং ইমাম সাহেবও কবির পাশে থেকে পায়ে পায়ে পথ চলেছিলেন।
Pic Source : Google |
এই ঘটনার প্রায় ৬ বছর পরে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভাতৃত্ব এবং সফলতার কাহিনী দিয়ে মোড়া ১৬ই আগস্ট কিন্তু শুধু এই কারণে মনে রাখা হয়, তেমনটা না। বাংলা ও বাঙালির জীবনে এই ১৬ আগস্ট এক ইতিহাস, উদারতার এক পদাবলির পাণ্ডুলিপি হলেও, এর শেষ পাতায় দেখা মেলে ভাতৃত্বেরই রক্তাক্ত রূপ, যা ছিল রাজনীতির রঙে রাঙানো।
১৯৪০-এর দশকে ভারতের গণপরিষদের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিমলিগ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় নেতৃবর্গের হাতে ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। এই প্রস্তাবে একটি নতুন ভারত অধিরাজ্য ও তার সরকার গঠনেরও প্রস্তাব জানানো হয়। পরবর্তীতে, একটি বিকল্প প্রস্তাবে হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলমানপ্রধান পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা জানানো হয়। কিন্তু, জাতীয় কংগ্রেস বিকল্প প্রস্তাবটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এবং একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিমলিগ ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগস্ট একটি সাধারণ ধর্মঘটের (হরতাল) ডাক দেয়।
কংগ্রেস অধিবেশন |
মুসলিম লীগ |
এই প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই কলকাতায় এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম হয়। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরে চার হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান ও এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন। কলকাতার দেখাদেখি দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, যুক্তপ্রদেশ (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও। তবে সর্বাপেক্ষা ভীতিপ্রদ দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল কলকাতা ও নোয়াখালীতে (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে)। এই ঘটনাই ভারত বিভাগের বীজকে আরও বল প্রদান করে বসে। একসপ্তাহ জুড়ে চলে এই ভয়ংকর দাঙ্গা, ওই সপ্তাহটি “দীর্ঘ ছুড়িকার সপ্তাহ” ("The Week of the Long Knives") নামে কুখ্যাতি পায়।
“প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের” পর কলকাতার রাজপথে ছড়িয়ে থাকা নিহতদের দেহ |
কলকাতা দাঙ্গা বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস অর্থাৎ কুখ্যাত সেই সপ্তাহকালের প্রথম দিন, ১৬ই আগস্টই ছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতায় সংঘটিত একটি বহুবিস্তৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নরহত্যার ঘটনা।
দাঙ্গার পর কলকাতার অলিগলি |
স্বাধীনতার এক বছর পূর্বে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংঘটিত এই দাঙ্গায় চার হাজারেরও বেশি নিরীহ হিন্দু ও মুসলমান নিহত হয়েছিলেন।
সুতরাং, বোঝায় যায় কেন ১৬ই আগস্ট আজ ভারতবাসীর কাছে স্মরণীয়!