আজও মনে পড়ে সেই ছেলেটির কথা। আমি তখন বজবজ বটলিং প্ল্যান্টে চাকরী করি, আমার এক সহকর্মীর গয়টার অপারেশনের জন্য কলকাতার একটি নামী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হল, ঐ কলিগের ওয়াইফ বলল, আমার আর কেউ নেই আপনাকে রাতে থাকতে হবে, আমি হসপিটালে সারা রাত থাকলাম। যাই হোক, অপারেশনে ঠিকঠাক হল। রাতে আমি রেস্টরুমে বসে। একজন আমার পাশে এসে বসলো। সে নিজে থেকেই আলাপ করলো, বয়স কত হবে, বাইশ তেইশ!
আমি জিঞ্জাসা করলাম, তোমার নাম?
আমি আশরাফুল, বাংলা দেশ থেকে এসেছি।
কেন?
আমার বাবা ভর্তি আছে।
আমার ওয়াইফ আমাকে খাবার দিয়েছিল, আমরা ভাগ করে খেলাম।
বাড়িতে কে আছে?
আমার আম্মি, আর আমার ছোট বোন তনুজা। আমি প্রায় পঁচাত্তর দিন আছি।
তোমার বাবার কি হয়েছে, বাবার পেটে অপারেশন হয়েছে।
তা এখন কেমন আছেন?
রোজই তো খবর নিচ্ছি, কেউ ঠিক মত বলছে না।
দু-তিন দিন এই ভাবেই কেটে গেলো, যেন সে কত আপন, জিঙ্গাসা করলাম অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তো?
সব জমি জামা বেচে দিয়েছি, শুধু আম্মির জন্যে, আমার আম্মি ঠিক মত খায় না। শুধু আম্মির মুখে হাসি দেখতে চাই।
তা তুমি এখানে একা?
হ্যাঁ। আমি কিছু বলতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলাম। কাল আমার কলিগকে ছেড়ে দেবে, কিন্তু ছেলেটার প্রতি অজান্তেই একটা মায়া পড়ে গেছে। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, হঠাৎই কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, ছেলেটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর আম্মি আম্মি বলে চিৎকার করছে, তার বুকফাটা আর্তনাদ আমাকে বিহ্বল করে তুলল, আমারও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে, আমারও বাবার মৃত্যুর পর আমার মা পাগলিনির মত কেঁদেছিলেন, তখন আমি বেকার, সব কথা মনে পড়ছিল, যার বাবা মা চলে যায় সেই বোঝে কি যায়, নিজেকে সামলে, ওকে বুঝিয়ে লাশ নিলাম, জিঞ্জাসা করলাম তুমিকি বাংলাদেশে নিয়ে যাবে? ও কিছু বলতে পারছিল না। ততক্ষনে অনেকে এসে হাজির হল। যাই হোক, কয়েকজন ছেলে এলো, আমি বললাম কবরের ব্যবস্থা করতে হবে...তোমরা একটু।
আঙ্কেল আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, আমরা...।
আমি আস্বস্থ হলাম, কারন আমার পেসেন্টকে ছেড়ে আমি কি করে যাই। কিছু টাকা দিতে গেলাম, আঙ্কেল কিছু ভাববেন না, আমরা সব ব্যবস্থা করে নেবো। একটা ফুলের তোড়া এনে ওর আব্বুর গায়ে দিয়ে নমস্কার করলাম।
গাড়ি ছেড়ে দিল, ছেলেটি আমার দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভিতরটায় যে কি হচ্ছিল। আজও আমি সে কথা ভুলিনি।